ইনানা
From Wikipedia, the free encyclopedia
ইনানা[lower-alpha 1] হলেন প্রাচীন মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে পূজিত প্রেম, সৌন্দর্য, যৌনতা, যুদ্ধ, ন্যায়বিচার ও রাজনৈতিক ক্ষমতার দেবী। প্রথমে সুমের অঞ্চলে তার পূজার প্রচলন ঘটে। পরবর্তীকালে আক্কাদীয়, ব্যাবিলনীয় ও আসিরীয়রা ইশতার নামে[lower-alpha 2] তার পূজা করত। ইনানা পরিচিত ছিলেন "স্বর্গের রানি" নামে। তিনি ছিলেন উরুক শহরের এয়ান্না মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। এই মন্দিরটিই ছিল তার প্রধান কাল্ট কেন্দ্র। প্রাচীন মেসোপটেমীয়দের দৃষ্টিতে ইনানা যুক্ত ছিলেন শুক্র গ্রহের সঙ্গে। তার প্রধান প্রতীকগুলির অন্যতম ছিল সিংহ ও আটটি কোণবিশিষ্ট তারা। তার স্বামী ছিলেন দেবতা দুমজিদ (গ্রিক পুরাণে যিনি অ্যাডোনিসে পরিণত হন) এবং তার সুক্কাল অর্থাৎ নিজস্ব পরিচারিকা ছিলেন দেবী নিনশুবুর (পরবর্তীকালে যিনি পুরুষ দেবতা পাপসুক্কালে পরিণত হয়েছিলেন)।
ইনানা (ইশতার) | |
---|---|
| |
আবাস | স্বর্গ |
গ্রহ | শুক্র |
প্রতীক | আঁকশির আকৃতিবিশিষ্ট শরের গ্রন্থি, আটটি কোণবিশিষ্ট তারা, সিংহ, রোজেট, পায়রা |
ব্যক্তিগত তথ্য | |
মাতাপিতা | |
সহোদর |
|
সঙ্গী | মেষপালক দুমুজিদ ও অন্য অনেক অনামা বাল |
সন্তান | সচরাচর কেউ না, তবে কোনও কোনও ক্ষেত্রে লুলাল এবং/অথবা শারা |
সমকক্ষ | |
গ্রিক সমকক্ষ | আফ্রোদিতি, অ্যাথিনা[3][4][5] |
রোমান সমকক্ষ | ভেনাস, মিনার্ভা[3][4][5] |
কেনানীয় সমকক্ষ | আস্তোরেথ |
ব্যাবিলনীয় সমকক্ষ | ইশতার |
উরুক যুগের মধ্যেই (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০-৩১০০ অব্দ) সুমের অঞ্চলে ইনানার পূজার প্রচলন ঘটে। তবে আক্কাদের সারগোনের বিজয় অভিযানের আগে তাঁকে ঘিরে গড়ে ওঠা কাল্টটির পরিসর বিশেষ পরিব্যাপ্ত ছিল না। সারগোন-উত্তর যুগে অবশ্য ইনানা সুমেরীয় দেবমণ্ডলীর সর্বাধিক পূজিত দেবদেবীদের অন্যতম এক দেবীতে পরিণত হয়েছিলেন।[8][9] সমগ্র মেসোপটেমিয়ার নানা স্থানে তার মন্দির গড়ে উঠেছিল। ইনানা-ইশতারের কাল্টটিকে যৌনাচারের একটি প্রকারভেদের সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে। পূর্ব সেমিটিক-ভাষী জাতিগোষ্ঠীগুলির (আক্কাদীয়, আসিরীয় ও ব্যাবিলনীয়) মধ্যেও এই কাল্টের প্রচলন ঘটে। এই জাতিগোষ্ঠীগুলি সুমেরীয়দের ধর্মকে আত্মীভূত করে সেই ধর্মের উত্তরসূরিতে পরিণত হয়েছিল। আসিরীয়দের মধ্যে ইনানা বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তারা তাদের নিজস্ব জাতীয় দেবতা আশুরেরও ঊর্ধ্বে সর্বোচ্চ দেবীর মর্যাদা প্রদান করেছিল ইনানাকে। হিব্রু বাইবেলেও ইনানা-ইশতারের পরোক্ষ উল্লেখ পাওয়া যায়। ফোনিশীয় দেবী আস্তোরেথের উপর ইনানা-পুরাণকথার বিশেষ প্রভাব পড়েছিল। আস্তোরেথের কাহিনিটি আবার পরবর্তীকালে গ্রিক দেবী আফ্রোদিতির ধারণার বিকাশে সহায়তা করে। খ্রিস্টীয় প্রথম থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যে খ্রিস্টধর্মের উত্থান ঘটলে ইনানা কাল্টেরও ক্রমাবনতি ঘটতে শুরু করে। কিন্তু তার আগে পর্যন্ত এই কাল্ট যথেষ্ট সমৃদ্ধি অর্জন করেছিল। তাই অন্ততপক্ষে খ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত উচ্চ মেসোপটেমিয়ার কয়েকটি অংশে আসিরীয়দের মধ্যে এই কাল্টের অস্তিত্ব বজায় ছিল।
প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার পৌরাণিক সাহিত্যে সুমেরীয় দেবমণ্ডলীর অন্যান্য দেবদেবীদের তুলনায় ইনানার উল্লেখ অনেক বেশি বার করা হয়েছে।[10][11][12] ইনানা কর্তৃক অন্যান্য দেবদেবীদের জন্য নির্দিষ্ট ক্ষেত্র অধিকার করার কাহিনিগুলি বহু-সংখ্যক পৌরাণিক কথার মূল উপজীব্য বিষয় হয়ে ওঠে। কথি আছে, প্রজ্ঞার দেবতা এনকির কাছে সভ্যতার সকল ইতিবাচক ও নেতিবাচক ধ্যানধারণার প্রতীক মে-সমূহ রক্ষিত ছিল; ইনানা সেগুলি হরণ করেন। আরও মনে করা হত যে, আকাশের দেবতা আনের কাছ থেকে ইনানা অধিকার করে নিয়েছিলেন এয়ান্না মন্দিরটিকে। ইনানা ও তার যমজ ভাই উতু (যিনি পরবর্তীকালে শামাশ নামে পরিচিত হন) ছিলেন দৈব আইনের প্রয়োগকর্তা। ইনানার কর্তৃত্বের সম্মুখে "ঔদ্ধত্য প্রকাশের অপরাধে" তিনি এবিহ্ পর্বত ধ্বংস করেন, নিদ্রিত অবস্থায় তাঁকে ধর্ষণের অপরাধে তিনি মালী শুকালেতাদুর উপর নিজ ক্রোধ বর্ষণ করেন এবং স্বামী দুমুজিদকে হত্যা করার অপরাধে দৈব শাস্তি হিসেবে তিনি দস্যুনারী বিলুলুকে খুঁজে বের করে হত্যা করেন। গিলগামেশ মহাকাব্যের প্রামাণ্য আক্কাদীয় পাঠান্তরে জানা যায়, ইশতার গিলগামেশকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু গিলগামেশ তাঁকে বিবাহ করতে অসম্মত হন। ক্রুদ্ধ ইশতার তার পিছনে স্বর্গীয় বৃষ লেলিয়ে দেন। ফলে এনকিডুর মৃত্যু ঘটে এবং গিলগামেশও অমরত্বের আকাঙ্ক্ষায় বিভোর হয়ে ওঠেন।
ইনানা-ইশতারের প্রেতলোকে (কুর) অবতরণ ও স্বর্গে প্রত্যাবর্তনের উপাখ্যানটি তার সর্বাধিক পরিচিত পৌরাণিক কাহিনি। এই কাহিনি অনুসারে, ইনানার দিদি এরেশকিগাল ছিলেন প্রেতলোকের রানি। ইনানা তার রাজ্য দখল করার চেষ্টা করলে প্রেতলোকের সাত বিচারক তাঁকে আত্মম্ভরিতার অপরাধে মৃতুদণ্ড প্রদান করেন। তিন দিন বাদে নিনশুবুর সকল দেবতার কাছে ইনানাকে ফিরিয়ে আনার আর্জি জানান। কিন্তু এনকি ছাড়া অন্য কেউই এই কাজে সহযোগিতা করতে রাজি হননি। ইনানাকে উদ্ধার করার জন্য এনকি দুই নির্লিঙ্গ সত্ত্বাকে প্রেতলোকে প্রেরণ করেন। তারা ইনানাকে নিরাপদে প্রেতলোক থেকে ফিরিয়ে আনলেও সেখানকার তত্ত্বাবধায়ক গাল্লা দানবেরা পরিবর্তে তার স্বামী দুমুজিদকে প্রেতলোকে টেনে নিয়ে যায়। ঘটনাচক্রে দুমুজিদ বছরে ছয় মাস স্বর্গে বাস করার অনুমতি লাভ করেন। প্রাচীন মেসোপটেমীয়রা মনে করত, দুমুজিদের ছয় মাস স্বর্গবাস কালে তার বোন জেশতিয়ানা প্রেতলোকে থাকেন এবং সেই কারণেই ঋতুচক্র আবর্তিত হয়।