ভূসংস্থানিক মানচিত্র
মাঝারি থেকে বৃহৎ মাপের মানচিত্র যাতে ভূ-পৃষ্ঠের বন্ধুরতাকে সাধারণত সমোন্নত রেখাসমূহের মাধ্যমে / From Wikipedia, the free encyclopedia
আধুনিক মানচিত্র-অঙ্কন বিদ্যায় ভূসংস্থানিক মানচিত্র বা ভূসংস্থানিক পত্র বলতে এমন এক ধরনের মানচিত্রকে বোঝায়, যাতে ভূপৃষ্ঠের কোনও নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের আকৃতি, বন্ধুরতা, ঢাল ও অন্যান্য ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যসমূহের সঠিক, সূক্ষ্ম ও বিস্তারিত পরিমাণবাচক উপস্থাপন করা হয়। এইসব তথ্য-উপাত্ত মানচিত্রটিতে বিভিন্ন উপায়ে জ্ঞাপন করা হতে পারে। যেমন মানচিত্রটির মাপনী (স্কেল) দিয়ে মানচিত্রে প্রদর্শিত স্থানগুলির মধ্যে দূরত্ব এবং প্রকৃত ভূ-পৃষ্ঠে সেগুলির মধ্যে দূরত্বের মধ্যে সম্পর্ক প্রদান করা হয় সমোন্নতি রেখাগুলির (Contour line) মাধ্যমে একই ভৌগোলিক উচ্চতায় অবস্থিত বিন্দুগুলিকে সংযুক্ত করা হয় এবং এভাবে ভূখণ্ডটির বিভিন্ন ভূমিরূপের উঁচুনিচু ত্রিমাত্রিক বাস্তবতার একটি দ্বিমাত্রিক দৃশ্য উপস্থাপন করা হয়। সমোন্নতি ব্যবধি (Contour interval) হল সমোন্নতি রেখাগুলির মধ্যে উচ্চতার পার্থক্য, যা মানচিত্রে খুঁটিনাটি বিবরণের মাত্রা নির্দেশ করে।
ঐতিহ্যগত সংজ্ঞাগুলি অনুযায়ী একটি ভূসংস্থানিক মানচিত্রকে একই সাথে কোনও ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম মানবনির্মিত ভূ-সংস্থানিক বৈশিষ্ট্যগুলি প্রদর্শন করতে হয়।[1] উঁচু পর্বত ও পাহাড়গুলি সাধারণত সমকেন্দ্রিক বৃত্তাকার সমোন্নতি রেখা দিয়ে প্রকাশ করা হয়। অন্যদিকে উপত্যক্য ও অবনমিত অঞ্চলগুলিকে ঘনিষ্ঠ সমোন্নতি রেখাসমষ্টি বা ইংরেজি ভি-আকৃতির মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। জলপ্রবাহগুলিকে (নদী, খাল, ইত্যাদি) নীল বর্ণের রেখা দিয়ে প্রকাশ করা হয় এবং এগুলির গতিপথ ও অভিমুখও নির্দেশ করা হয়। জলাশয়গুলির (যেমন হ্রদ ও পুকুর) পরিসীমা নীল রেখা দিয়ে আঁকা থাকে এবং এগুলির অভ্যন্তরভাগ নীলের বিভিন্ন আভা দিয়ে পূর্ণ করা থাকে (কদাচিৎ গভীরতা নির্দেশ করা হতে পারে)। বনাবৃত অঞ্চলগুলির উদ্ভিদের প্রকৃতি নির্দেশ করার হন্য বিভিন্ন প্রতীক ও আভার সাহায্য নেয়া হতে পারে। মানবনির্মিত বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে আছে সড়ক ও মহাসড়ক (যেগুলিকে বিভিন্ন শৈলী ও প্রস্থের রেখা দিয়ে নির্দেশ করা হয়), ভবন, সেতু, বসতি ও স্থাপনা (যেগুলিকে প্রতীক দিয়ে নির্দেশ করা হয়), রেলপথ (যেগুলিকে রেখা ও প্রতীক দিয়ে নির্দেশ করা হয়), দেশ, অঞ্চল ও বৈচারিক এলাকার রাজনৈতিক সীমান্ত, বিদ্যুৎ সরবরাহ পথ, ইত্যাদি।
একটি ভূসংস্থানিক মানচিত্র বেশ কয়েকটি ধাপে প্রস্তুত করা হয়। প্রথমে মাঠ পর্যায়ের জরিপ বা বৈমানিক চিত্রগ্রহণের মাধ্যমে প্রণালীবদ্ধ পর্যবেক্ষণের দ্বারা তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। প্রথমে একটি ভিত্তি মানচিত্র প্রতিষ্ঠা করে সেগুলিতে জানা উচ্চতার বিন্দুগুলিকে স্থাপন করা হয়। তারপর একই উচ্চতার বিন্দুগুলিকে সমোন্নতি রেখা দ্বারা সংযুক্ত করা হয়। দুইটি সমোন্নতি রেখার মধ্যবর্তী অঞ্চলে উচ্চতার উপর ভিত্তি করে গাঢ় বা হালকা রঙ প্রয়োগ করা হয়। প্রাকৃতিক ও মানবনির্মিত বৈশিষ্ট্যগুলি প্রতীক ও রেখার মাধ্যমে যোগ করা হয়। ভৌগোলিক স্থানাংক, সমোন্নতি রেখার উচ্চতামান, উত্তরমুখী তীরচিহ্ন, ও মাপনীনির্দেশক রেখাংশ যোগ করা হয়। এরপর এগুলিকে ধারাবাহিক মানচিত্রাবলীর আকারে প্রকাশ করা হয়। মানচিত্রাবলীতে দুই বা ততোধিক মানচিত্র থাকে যেগুলি যৌথভাবে পূর্ণাঙ্গ মানচিত্রটি গঠন করে। একটি ভূসংস্থানিক মানচিত্রাবলীর মানচিত্রগুলি একটি সাধারণ বিনির্দেশ মেনে চলে, যাতে মানচিত্র প্রতীকসম্ভারের ব্যবহার ছাড়াও একটি আদর্শ ভূমিতিক পরিকাঠামো অন্তর্ভুক্ত থাকে। পরিকাঠামোটিতে মানচিত্র অভিক্ষেপ, স্থানাংক ব্যবস্থা, উপগোলক ও ভূমিতিক প্রসঙ্গকাঠামো সংজ্ঞায়িত থাকে। আনুষ্ঠানিক ভূসংস্থানিক মানচিত্রগুলিতে জাতীয় বর্গজালি প্রামাণ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে। ভূসংস্থানিক পার্শ্বচিত্রগুলিতে (Topographic profile) কোনও নির্দিষ্ট পথ বরাবর উচ্চতার তারতম্য প্রদর্শিত হয়।
পরিব্রাজন (হাইকিং), নগর পরিকল্পনা, ভূতাত্ত্বিক গবেষণা, অবকাঠামো নির্মাণ ও সামরিক অভিযানসহ আরও বহু ক্ষেত্রে ভূসংস্থানিক মানচিত্র ব্যবহৃত হয়। পরিব্রাজকেরা এই মানচিত্র ব্যবহার করে তাদের পছন্দের যাত্রাপথ ঠিক করতে পারে ও অপরিচিত অঞ্চলের মধ্য দিয়ে নিরাপদে যাত্রা করতে পারে। নগর পরিকল্পনাবিদেরা এই মানচিত্র ব্যবহার করে কোনও নির্বাচিত ভূমি নগর উন্নয়নের জন্য টেকসই হবে কিনা তা ঢাল, উচ্চতা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য দেখে যাচাই করেন। ভূতাত্ত্বিকেরা এই মানচিত্রের মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠ অধ্যয়ন করে ও ভূতাত্ত্বিক গঠনগুলি শনাক্ত করেন। অবকাঠামো যেমন সড়ক, সেতু বা নলপথ নির্মাণের সময় এই মানচিত্রগুলিতে প্রদত্ত সঠিক উপাত্তগুলি ঐসব অবকাঠামোর আকার-আকৃতি ও অভিমুখ পরিকল্পনা করতে ও নির্মাণকাজে সম্ভাব্য সমস্যা যাচাই করতে সাহায্য করে। সামরিক অভিযানে রণকৌশল পরিকল্পনায় ভূসংস্থানিক মানচিত্রগুলি খুবই জরুরি।