সমুদ্রের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
From Wikipedia, the free encyclopedia
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের উপর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। এর অন্যতম প্রধান প্রভাব হলো সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি। এর ফলে বারবার সামুদ্রিক তাপপ্রবাহের সৃষ্টি হচ্ছে। সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়া, সমুদ্র অম্লীকরণ, সামুদ্রিক বরফ হ্রাস, সমুদ্রস্তর বিভাজনের বৃদ্ধি এবং অক্সিজেনের মাত্রা হ্রাস - এগুলোও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের ওপর পড়া অন্যান্য উল্লেখযোগ্য প্রভাব। 'আটলান্টিক মেরিডিয়নাল ওভারটার্নিং সার্কুলেশন' (AMOC) সহ সামুদ্রিক স্রোতের ব্যাপক পরিবর্তনও লক্ষ্য করা যাচ্ছে।[2] জলবায়ু পরিবর্তনের এই পরিণতিগুলো সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বিনষ্ট করছে।[3] মানুষের তৈরি গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণই জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ। কার্বন ডাই অক্সাইড এবং মিথেন গ্যাস গ্রিনহাউজ গ্যাসের কয়েকটি উদাহরণ। জলবায়ু ব্যবস্থার অতিরিক্ত তাপের বেশিরভাগটাই সমুদ্র শোষণ করে নেওয়ায় সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।[4] এছাড়া, বায়ুমণ্ডলে অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইডের একটি বড় অংশ সমুদ্র গ্রহণ করে। যার ফলে সমুদ্রের পানির pH মাত্রা কমে যাচ্ছে।[5] বিজ্ঞানীদের হিসেব মতে, মানুষের সৃষ্ট মোট কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের প্রায় ২৫% সমুদ্র শোষণ করে নেয়।[6]
মহাসাগরের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে তাপমাত্রার পার্থক্যকে মহাসাগরের তাপমাত্রার স্তরবিন্যাস বলা হয়। বায়ুর তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠ উষ্ণ হওয়ার সাথে সাথে এটি বৃদ্ধি পায়।[7]:৪৭১ সমুদ্রের স্তরগুলির মিশ্রণ হ্রাস পাওয়াতে সমুদ্রপৃষ্ঠের কাছাকাছি উষ্ণ পানি স্থির হয়ে যায়। এটি গভীর থেকে ঠান্ডা পানির প্রবাহকেও কমিয়ে দেয়। মিশ্রণ কমে যাওয়ার ফলে মহাসাগর তাপ শোষণ করতে পারে না। ফলে ভবিষ্যতের উষ্ণায়নের একটি বড় অংশ বায়ুমণ্ডল এবং ভূমিতে স্থানান্তরিত হয়। এর একটি ফলাফল হলো ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় এবং অন্যান্য ঝড়ের জন্য উপলব্ধ শক্তির পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া। আরেকটি ফলাফল হলো মহাসাগরের উপরের স্তরে মাছের পুষ্টির পরিমাণ হ্রাস। এই পরিবর্তনগুলি মহাসাগরের কার্বন সংরক্ষণের ক্ষমতাও হ্রাস করে।[8] একই সাথে, লবণাক্ততার বৈসাদৃশ্যও বাড়ছে। নোনা এলাকাগুলি আরও নোনা হয়ে উঠছে এবং অপেক্ষাকৃত কম লবণাক্ত এলাকাগুলি আরও কম নোনা হচ্ছে।[9]
উষ্ণ পানি ঠান্ডা পানির তুলনায় কম অক্সিজেন ধারণ করতে পারে। এর ফলে, মহাসাগর থেকে অক্সিজেন বায়ুমণ্ডলে চলে যায়। বর্ধিত তাপীয় স্তরবিন্যাস পৃষ্ঠের পানি থেকে গভীর পানিতে অক্সিজেন সরবরাহ কমিয়ে দিতে পারে। এটি পানির অক্সিজেনের পরিমাণ আরও কমিয়ে দেয়।[10] মহাসাগর ইতিমধ্যে তার পুরো পানিস্তম্ভে অক্সিজেন হারিয়েছে। অক্সিজেন ন্যূনতম অঞ্চল বিশ্বব্যাপী প্রসারিত হচ্ছে।[11]:৪৭১
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উষ্ণতর পানির তাপমাত্রা সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের জন্য গুরুতর সমস্যা তৈরি করে। এই পরিবর্তনগুলি সামুদ্রিক প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটাতে পারে[12] বা কিছু প্রজাতির জনসংখ্যা বিস্ফোরণের দিকে পরিচালিত করতে পারে, যার ফলে প্রজাতির বন্টন সম্পূর্ণভাবে বদলে যেতে পারে।[13] এর ফলে উপকূলীয় মৎস্যচাষ ও পর্যটনশিল্প মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি বিভিন্ন সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র যেমন প্রবাল প্রাচীরের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। তাপমাত্রার সামান্য পরিবর্তনই প্রবাল প্রাচীরকে সাদা করে ফেলতে (কোরাল ব্লিচিং) পারে যা এইসব ভঙ্গুর প্রাচীরের পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে দিতে পারে। এছাড়াও, সমুদ্রের অম্লীকরণ এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধি সমুদ্রের উৎপাদনশীলতা ও প্রজাতির বন্টনকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। ফলে, বৈশ্বিক মৎস্যচাষ মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হয় এবং সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বিনষ্ট হতে থাকে। উষ্ণতার কারণে সমুদ্রের বরফ গলে যাওয়া মেরু অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি। মেরু ভালুকের মতো অনেক মেরু প্রাণীর অস্তিত্ব আজ চরম বিপদের মুখে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই নানামুখী প্রতিক্রিয়া জলবায়ু ব্যবস্থা এবং সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের ওপর অভাবনীয় চাপ সৃষ্টি করছে।[14]