সামাজিক ডারউইনবাদ
From Wikipedia, the free encyclopedia
সামাজিক ডারউইনবাদ (ইংরেজি: Social Darwinism) হল সমাজের বিভিন্ন তত্ত্ব যা ১৮৭০ এর দশকে যুক্তরাজ্য, উত্তর আমেরিকা, এবং পশ্চিম ইউরোপে আবির্ভূত হয়। এটি সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রাকৃতিক নির্বাচন এবং যোগ্যতমের উদ্বর্তন এর ধারণা প্রয়োগ করার দাবি জানায়।[1] সামাজিক ডারউইবাদীগণ যুক্তি দেখান যে, সমাজের সবলরা দেখতে পাবে তাদের সম্পদ এবং ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যখন দুর্বলরা দেখবে তাদের সম্পদ এবং ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। কোন কোন দলকে শক্তিশালী এবং কোন কোন দলকে দুর্বল বলে মনে করা হবে, এবং কোন সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে সমাযে সবলরা পুরস্কার ও দুর্বলরা শাস্তি লাভ করে তা নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক-ডারউইনবাদী সম্প্রদায়গুলোতে মতভেদ রয়েছে। এই ধরনের অনেক দৃষ্টিভঙ্গি লেসে-ফেয়ার পুঁজিবাদের ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে প্রতিযোগিতায় জোড় দেয়, অন্য দৃষ্টিভঙ্গিগুলো কর্তৃত্ববাদ, ইউজেনিক্স, বর্ণবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ, নাৎসিবাদ, এবং জাতীয় বা জাতিগত গোষ্ঠীর মধ্যে সংগ্রামের সমর্থনে ব্যবহৃত হয়।[2][3][4]
একটি বৈজ্ঞানিক ধারণা হিসাবে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সামাজিক ডারউইনবাদ ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা হারায় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়। এর কারণ হল, প্রথমত এর সাথে নাৎসিবাদের সম্পর্ক, এবং দ্বিতীয়তঃ ক্রমবর্ধমান বৈজ্ঞানিক ঐকমত্য যে এই মতবাদটি বৈজ্ঞানিকভাবে ভিত্তিহীন।[5][6] পরবর্তীতে যেসব তত্ত্ব সামাজিক ডারউইনবাদ হিসেবে শ্রেণীকৃত ছিল, সেগুলো সাধারণত তাদের প্রতিপক্ষের সমালোচনা হিসেবে বর্ণনা করা হয়; এই মতগুলোর প্রবক্তারা নিজেদেরকে সামাজিক ডারউইনবাদী হিসেবে পরিচয় দেননি।[6][7] সৃষ্টিবাদীরা প্রায়ই সেই সামাজিক ডারউইনবাদ বজায় রেখেছেন, যার ফলে তারা সবচেয়ে বেশি যোগ্যকে পুরষ্কৃত করার নীতি পরিকল্পনা করেছেন, এই ব্যাপারটি আসলে ডারউইনবাদের যৌক্তিক পরিণাম (জীববিজ্ঞানের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব)।[8] জীববিজ্ঞানী এবং ঐতিহাসিকগণ বলেছেন যে এটি প্রকৃতিগত হেত্বাভাস বা আপিল টু নেচার নামক হেত্বাভাসে দুষ্ট, কেননা প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্বটিকে নিছকই জীববিজ্ঞানগত প্রপঞ্চকে বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয়, এবং এই ব্যাপারটি যে মানব সমাজের জন্য ভাল বা এটিকে মানব সমাজের নৈতিক নির্দেশনা হিসেবে ব্যবহার করতে হবে, যেহেতু প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্বটি নিছক একটি জৈবিক ঘটনার বর্ণনা হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং এর ফলে এটি নির্দেশিত হয়না যে, এই প্রাকৃতিক নির্বাচন মানব সমাজের জন্য ভাল বা এটি মানব সমাজে একটি নৈতিক নির্দেশিকা হিসাবে ব্যবহার করা উচিত।[9] যদিও অধিকাংশ পণ্ডিত ডারউইনের তত্ত্বের জনপ্রিয়করন এবং সামাজিক ডারউইনিজমের বিকাশের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করেন, তারা এটাও বলেন যে সামাজিক ডারউইনবাদ জীববিজ্ঞানগত বিবর্তনের নীতির অনিবার্য পরিণাম নয়।
সামাজিক ডারউইনবাদী মতাদর্শগুলোর মধ্যে কোনটি মানব সমাজ ও অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে চার্লস ডারউইনের নিজের মতের সাথে মিলে যায় তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। তার লেখায় এমন অনুচ্ছেদ আছে যাকে আগ্রাসী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বিরোধী বলে ব্যাখ্যা করা যায়, আবার এমনও অনুচ্ছেদ আছে যা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকে সমর্থন করে।[10] ডারউইনের প্রারম্ভিক বিবর্তনীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং তার দাসপ্রথার বিরোধিতা অনেক সামাজিক ডারউইনবাদী দাবিরই বিরুদ্ধে যায় যেগুলো পরবর্তীতে সামাজিক ডারউইনবাদীরা দরিদ্র এবং ঔপনিবেশিক আদিবাসীদের মানসিক ক্ষমতা নিয়ে তৈরি করেছিলেন।[11] ১৮৫৯ সালে ডারউইনের গ্রন্থ অন দ্য অরিজিন অফ স্পিসিজ প্রকাশিত হবার পর, স্যার জন লাবাক এর নেতৃত্বে ডারউইনের অনুগামীদের একটি অংশ যুক্তি দেন, সংগঠিত মানব সমাজ গঠিত হয়ে যাবার পর প্রাকৃতিক নির্বাচন কোনরকম উল্লেখযোগ্য প্রতিক্রিয়া দেখানো বন্ধ করে দিয়েছে।[12] যাইহোক, কিছু পণ্ডিত যুক্তি প্রদান করে যে ডারউইনের দৃষ্টিভঙ্গি ক্রমে পরিবর্তিত হয় এবং তিনি হার্বার্ট স্পেন্সার এর মত অন্যান্য তাত্ত্বিকদের তত্ত্বকে গ্রহণ করেন।[13] ডারউইন ১৮৫৯ সালে তার অনুকল্প প্রথম প্রকাশ করার আগেই স্পেন্সার সমাজ সম্পর্কে তার ল্যামার্কীয় বিবর্তনীয় ধারণাগুলো প্রকাশ করেন,[14] এবং স্পেনসার এবং ডারউইন উভয়েই নৈতিক মূল্যবোধ সম্পর্কে তাদের নিজেদের ধারণা প্রচার করেন। স্পেন্সার তার ল্যামার্কীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে লেসে-ফেয়ার পুঁজিবাদকে সমর্থন করেন, যেখানে তার সেই বিশ্বাসটি ছিল যে, টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম আত্ম-উন্নয়নের প্রেরণা দেয়, যা বংশ পরম্পরায় উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হয়।[15] জার্মানিতে সামাজিক ডারউইনবাদের একজন উল্লেখযোগ্য প্রবক্তা হচ্ছেন আর্নস্ট হেকেল, যিনি ডারউইনের চিন্তাধারা এবং তার উপর নিজের ব্যক্তিগত ব্যাখ্যাকে জনপ্রিয় করেন, আর এর মাধ্যমে তিনি মনিস্ট আন্দোলন বা একত্ববাদী আন্দোলন নামে একটি নতুন ধর্মবিশ্বাসের জন্মে অবদান রাখেন।